টিভি টা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। মাসের শেষ। পয়সা খরচ করতে ভয় পাচ্ছে সুমন। শিখা খুব টেনেটুনে চালায়। বিশেষ করে শেষ সপ্তাহটা। অথচ একদিনও সকালে মাছ- ভাত না খাইয়ে অফিসে পাঠায় না। ছেলে,মেয়ের রোজ একবেলা মাছ,একবেলা ডিম, আর একটা ফল বরাদ্দ। সুমন বোঝেনা, শিখা এত করে কি করে।
এরপর ছেলে, মেয়ের টিউশন ফি, মেয়ের গানের টিচার, ছেলের আঁকার টিচারের মাইনে। সুমন মাসের প্রথমেই বরাদ্দ টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। এরপর আর কোন ব্যাপারেই মাথা ঘামায়না। আর ঘামাতে ভয়ও পায়। কারণ হাত পা বাঁধা। আর চাইলে দেবে কোথা থেকে?
মা’কে কিছু খরচা পাঠাতে হয় প্রতিমাসে। বোন মা’কে নিয়ে গেছে নিজের কাছে। ওর মেয়েকে দেখাশুনো করার জন্য। ওরা মাঝে মধ্যেই পার্টিতে যায়, দেরী করে ফেরে, মেয়েকে কাজের লোকের হাতে রাখতে ভরসা পায় না। তাই মা ভরসা।
ছেলে হয়ে,সুমন তার দায়িত্ব পালন না করে পারে কি করে? বোনও কোনদিন বারণ করেনি।
একবারও বলেনি…দাদা, মা এর জন্য তো আমরা আছি। তুমি কেন পয়সা পাঠাচ্ছ?
বোনের বিয়ে ঠিক হ’বার সময়, যে ধার করেছিল অফিস থেকে,আজ অবধি পুরোটা শোধ হয়নি। নিজের ছেলে -মেয়ে বড় হচ্ছে। সব ভেবে কূল কিনারা পায়না সুমন।
নিজেদের শখ আহ্লাদ বলে কিছুই নেই। গ-তে বাঁধা জীবন। একটু এদিক -ওদিক হলেই চিন্তা হয়। শিখা মুখ ফুটে কিছু বলে নি কোনদিন।
বিয়ের পর থেকে সব মেনে, মানিয়ে চলেছে। তখন বাবাও বেঁচে ছিল। বোনের ও দাপট খুব। বেশ বড়লোকের বাড়ী থেকে ওকে পছন্দ করল যখন, সুমন বাবাকে বলেছিল, ওদের এত দাবী দাওয়া , আমরা কোথা থেকে দেব? সামান্য প্রাইভেট চাকরি, দুটো ছেলে- মেয়ে।
বোন তখন ওকে স্বার্থপর বলেছিল। মা, বাবার ও মুখ ভার। যেন বেশী আয় না করাটা কোন গর্হিত অপরাধ।
শিখা বলেছিল,বড় ভাই তুমি, যেখান থেকে পারবে যোগাড় করবে। ঐ অপবাদ আমি মেনে নেব না।
চারদিক থেকে ধার দেনা করে বিয়ে দিল বোনের। শিখা নিজের গয়না দিয়ে দিল সব। কিছুতেই ওর কথা শুনল না। সুমনের সামান্য অবমাননা কোনদিন সহ্য করতে পারে না ও। বাপের বাড়ী যায় না। অন্য ভাই বোনদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনা , তাদের নাক উঁচু ভাব সহ্য করতে পারেনা বলে।
আজ পর্যন্ত একটা গয়না গড়িয়ে দিতে পারেনি ও শিখাকে।
বাবা মারা গেল হঠাৎ খুব শ্বাসকষ্টে। মা দোষারোপ করে যায় সবসময়, বাবার ঠিকমত যত্ন হয়নি। অথচ, সাধ্যমত বাবা , মা’কে যত্নে রেখেছে ও।
দুটো ঘর, একটায় বাবা-মা, একটায় ওরা থাকত। এখন মা বোনের কাছে থাকায়, ঐ ঘরটায় ছেলে, মেয়ে দুটো পড়াশুনো করে।
কোন শখ নেই সুমনের , শুধু রাতে টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোর খবর শোনা ছাড়া। আজ তাও হচ্ছে না। হঠাৎ কি হল কে জানে।
দিন সাতেক আগে এ’রকম হয়েছিল, পাড়ার এক মেকানিক বলল, এটা তো গেছে দাদা, একটা নতুন কিনুন । আজকাল সস্তায় এল সি ডি ও পাওয়া যাচ্ছে। সে তো আর জানেনা, সুমনের অবস্থা। মুখের কথা নাকি নতুন টিভি কেনা!
সেদিন তাও চলছিল, আজ আর নয়।
চুপচাপ বসে ছিল। ছেলে মেয়ে পড়ছে। শিখা রান্নাঘরে।
রাতে, শিখা বলল, একটা নতুন টি ভি কিনে ফেল এবার।
পাগল হলে নাকি? টাকা কে দেবে?
আমি দেব।
তুমি? কোথায় পাবে?
সে জানতে হবেনা। আমি বলেছি দেব যখন দেব। তুমি কালই চল নতুন টিভি কিনতে।
ইনস্টলমেন্টেই কিনব না হয়।
সুমনের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। এতগুলো টাকা কোথায় পেল শিখা? কে দিল ওকে? তবে কি সুমন ছাড়াও ওর জীবনে কেউ আছে?
অথচ, জিজ্ঞেস করতেও বাধছিল। ওর পার্সোনালিটির কাছে বরাবরই হার মেনে যায় সুমন।
পরদিন, ইনস্টলমেন্টে একটা টি ভি কিনেই আনল ওরা।
ছেলে মেয়েদুটোর খুব উৎসাহ। কিন্তু,সুমন একবার ও টিভির সামনে বসল না।
রাতে শিখা বলল…বল, রাগ করবেনা। একটা কথা বলব তোমাকে?
কি কথা?
আমি গত পাঁচ বছর ধরে , তোমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্টেশনের কোণের দোকানে জামা কাপড় ইস্ত্রী করে…ছেলে, মেয়ে বাড়ী ফেরার আগেই ফিরে আসি। রোজ হাতে ভালই আসে। বলিনি কখন ও তোমাকে। দোকানের মালিককেও বলতে বারণ করে দিয়েছি। ভট্টাচার্য বাড়ীর বৌ, এই কাজ কি আমাকে মানায়? কিন্তু কি করব বল, কোন যোগ্যতা নেই যে এই বয়সে কোথাও চাকরি পাব। কোন স্কুলেও পড়ানোর মত ডিগ্রী নেই। ভেবে দেখলাম, সম্মানের পথে যদি দুটো পয়সা আয় করি, সংসারের সুরাহা হয়। তবে তুমি যদি রাগ কর, তাই কিছু বলিনি। ঐ টাকায় আমি আর ডি করেছি দুটো। একটা তিনদিন আগেই ম্যাচিওরড হয়েছিল। ঐ টাকাতেই কিনলাম টিভিটা।
লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল সুমন। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল খুব। না, শিখার কাজের জন্য নয়। একবারের জন্য শিখার চরিত্র নিয়ে মনে মেঘ জমা হয়েছিল..সেই জন্য।
Related Images:

মন্তব্য করুন